নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলোর (আইসিডি) গড়ে ৫০ শতাংশ চার্জ বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকট নিরসনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। বেসরকারি ডিপোগুলোতে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধির কারণে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর ব্যবহারকারী ও বিকডার (বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন) প্রতিনিধিদের এক টেবিলে এনেছিল, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই এই বৈঠক শেষ হয়েছে। গতকাল সকালে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেও উভয় পক্ষকে একমত করতে না পেরে বন্দর কর্তৃপক্ষ হতাশা ব্যক্ত করেছে।
বন্দর ব্যবহারকারীদের উদ্বেগ, বিকডার অনড় অবস্থান
বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ এক লাফে এত বাড়ানোর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামবে। তাদের অভিযোগ, ট্যারিফ কমিটির মতামত বা কোনো তোয়াক্কা না করে বিকডা একতরফাভাবে এই চার্জ বৃদ্ধি করেছে।
অন্যদিকে, বিকডা জানিয়েছে যে, তারা বর্ধিত চার্জ আদায় করবে। বিকডার যুক্তি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে খরচ তেমন বাড়ছে না। তাছাড়া বিকডার যাবতীয় চার্জ পরিশোধ করে বিদেশি বায়ার, এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ অহেতুক বিষয়টিকে ঘোলা করছে। বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, ট্যারিফ কমিটির কোনো বৈধতা নেই এবং তাদের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত আসবে না বলেই তারা কমিটি বাদ দিয়ে চার্জ বাড়িয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চার্জ বৃদ্ধি ছাড়া বিকল্প ছিল না এবং এই বৃদ্ধিতে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কোনো ক্ষতি হবে না, কারণ বিদেশি আমদানিকারকই ট্যারিফ পরিশোধ করবেন।
বন্দর কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ ও এক মাসের সময়সীমা
এই অচলাবস্থার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান উভয় পক্ষকে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে এক মাসের মধ্যে ট্যারিফ নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এক মাসের মধ্যে এই সমস্যার সুরাহা না হলে বন্দর কর্তৃপক্ষ সবকিছু জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেবে এবং মন্ত্রণালয় থেকেই ট্যারিফের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হওয়ায় বন্দরের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯টি বেসরকারি আইসিডি গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এবং গতিশীলতা বহুলাংশে এসব আইসিডির কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল। বেসরকারি আইসিডিগুলোর কন্টেইনার ধারণক্ষমতা এক লাখ ছয় হাজার টিইইউএস, যা বন্দরের ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। বছরে প্রায় ২২ লাখ কন্টেইনার এসব আইসিডিতে হ্যান্ডলিং হয়। রপ্তানির সব পণ্যই এখানে কন্টেইনারজাত করে জাহাজিকরণের জন্য বন্দরে পাঠানো হয় এবং বন্দরের ইয়ার্ডে নামা ৬৫ ধরনের আমদানি পণ্য খালাসের জন্য এসব আইসিডিতে যায়। ফলে এ খাতের ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে পড়বে।
১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া নতুন ট্যারিফ অনুযায়ী, ২০ ফুটি একটি কন্টেইনারের প্যাকেজ চার্জ ৬ হাজার ১২৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ৯০০ টাকা (প্রায় ৬২ শতাংশ বেশি) করা হয়েছে। ৪০ ফুটি কন্টেইনারের চার্জ ৮ হাজার ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩ হাজার ২০০ টাকা এবং ৪০ ফুটি হাইকিউব কন্টেইনারের চার্জ ৮ হাজার ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার ৯০০ টাকা করা হয়েছে। পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জিওএইচ কার্গোর চার্জও বাড়ানো হয়েছে, যেখানে ২০ ফুটি কন্টেইনারের জন্য ১১ হাজার ৯০০ টাকা, ৪০ ফুটি কন্টেইনারের জন্য ১৫ হাজার ২০০ টাকা এবং হাইকিউব কন্টেইনারের জন্য ১৬ হাজার ৯০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। রেফার কন্টেইনারের প্লাগইন চার্জ ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২০০ টাকা, ডকুমেন্টেশন চার্জ ২৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫০ টাকা, ২০ ফুটি খালি কন্টেইনার পরিবহন ১ হাজার ৭০৫ থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা, সিএফএস স্টোরেজ প্রতিদিন ২৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫ টাকা করা হয়েছে। নতুন ট্যারিফে ভিজিএম চার্জ বাবদ ১ হাজার ৭২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল না।
বৈঠকে বিকডা ছাড়াও বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারসসহ বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।