বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, যা পর্যটকদের কাছে স্বপ্নের গন্তব্য, সেখানেই এখন ঘুরছে মৃত্যুর অশুভ ছায়া। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতের প্রায় ১১৭ কিলোমিটারই পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মাত্র ৩ কিলোমিটার এলাকায় হাতেগোনা কিছু লাইফগার্ড থাকলেও, তাদের সংখ্যা এতটাই অপ্রতুল যে তা বিপুল সংখ্যক পর্যটকের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এর ফলস্বরূপ, কক্সবাজারে সাগরে ডুবে পর্যটক মৃত্যুর ঘটনা কমছে না, বরং দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, পর্যটকদের দ্রুত উদ্ধারের জন্য কোনো প্রশিক্ষিত ডুবুরি দল নেই।
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) কক্সবাজারের পেঁচারদ্বীপ সমুদ্রসৈকতে গোসল করতে নেমে চট্টগ্রামের দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাবাব ও আসিফ আহমেদ মারা গেছেন। একই ঘটনায় আরেক শিক্ষার্থী অরিত্র হাসানের এখনও কোনো খোঁজ মেলেনি। এই পেঁচারদ্বীপ সৈকতে পর্যটকদের আনাগোনা তুলনামূলক কম হওয়ায় এখানে লাইফগার্ডের কোনো ব্যবস্থা নেই, যা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে জেলা প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস এবং লাইফগার্ড কর্মীরা দ্রুত তৎপরতা চালালেও, প্রশিক্ষিত ডুবুরি দলের অনুপস্থিতি উদ্ধার কার্যক্রমকে গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। বর্তমানে উদ্ধারকাজ শুধুমাত্র জেট স্কির উপর নির্ভরশীল। কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মো. তানহারুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, “সাগরে যদি কেউ ডুবে যায়, তার কিছু সময় পর বা জোয়ারের সময় ভেসে আসে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। সাগরে তল্লাশি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ডুবুরি দল নেই।”
বর্ষা মৌসুমে সাগর উত্তাল থাকে এবং এর স্রোতও অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। পর্যটকদের সতর্ক করতে সৈকতের বালিয়াড়িতে লাল পতাকা টাঙানো হয়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেক পর্যটকই এই সতর্কতা মানেন না। ট্যুরিস্ট পুলিশ জানিয়েছে, এই অসতর্কতাই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।
কক্সবাজারস্থ ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ পর্যটকদের প্রতি জোর অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “সাগর উত্তাল থাকলে নামা যাবে না। স্রোতের টানে সমুদ্রস্নান করবেন না। অতি উৎসাহ দেখাবেন না। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের অসতর্কতার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে। বৈরী আবহাওয়ায় সাগর বেশি উত্তাল থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলি, যেন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমুদ্রস্নান বন্ধ রাখা হয়।”
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবনী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে কিছু লাইফগার্ড কর্মী থাকলেও, তাদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। এছাড়াও, উদ্ধারের জন্য পর্যাপ্ত আধুনিক সরঞ্জামও নেই। সী সেফ লাইফগার্ড সংস্থার প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. ইমতিয়াজ আহমেদ উল্লেখ করেছেন, “ইনানী, পাতুয়ারটেক থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে দক্ষ লাইফগার্ড কর্মী থাকা প্রয়োজন।” তার মতে, পর্যাপ্ত কর্মী থাকলে দ্রুত উদ্ধার কাজ চালানো সম্ভব হবে এবং পর্যটকদের আরও কার্যকরভাবে সতর্ক করা যাবে, যা তাদের সমুদ্রস্নানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
লাইফগার্ড সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে সমুদ্রে গোসলে নেমে ৬১ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে, যেখানে সহস্রাধিক মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই পরিসংখ্যান সমুদ্রসৈকতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট করে তোলে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে পর্যাপ্ত লাইফগার্ড নিয়োগ, আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম সরবরাহ এবং একটি প্রশিক্ষিত ডুবুরি দল গঠন করা অপরিহার্য।