শহরের কোলাহলে আমরা প্রতিদিনই তাদের দেখি। কেউ ভাঙা কাগজ কুড়োচ্ছে, কেউ গাড়ির কাচে পানি ছিটিয়ে মুছছে, কেউবা লালবাতি জ্বলা মাত্রই ফুল হাতে এগিয়ে আসছে। কেউবা রেলস্টেশনের ময়লা মেঝেতে কাগজ বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছে, আবার কেউ দোকানের পেছনের আবর্জনার স্তূপে খুঁজছে আধখাওয়া ভাত। এরা আমাদের সমাজের অদৃশ্য মানুষ—যাদের আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি উপেক্ষা করতে। অথচ তারা শিশু, আমাদেরই সন্তানদের মতোই একসময়ের কান্না, হাসি, খেলাধুলা আর স্বপ্ন নিয়ে জন্মেছিল। শুধু পার্থক্য হলো—তাদের জীবনে শৈশবের সোনালি আলো পৌঁছায়নি।
আজ পথশিশু দিবস বা সুবিধাবঞ্চিত শিশু দিবস। ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ হয়তো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাস্তার সেই ছোট্ট হাতগুলোরও তো অধিকার আছে কলম ধরার, স্কুলে যাওয়ার, মায়ের কোলে ঘুমানোর। প্রশ্ন হলো, আমরা কি আদৌ তাদের সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে পেরেছি?
শৈশব মানে হওয়া উচিত মুক্ত আকাশ, রঙিন ঘুড়ি, নতুন বইয়ের গন্ধ, কিংবা মায়ের গল্প শোনা রাত। কিন্তু পথশিশুর কাছে শৈশব মানে অন্য কিছু। শৈশব মানে ক্ষুধা মেটাতে দিনভর ভিক্ষা, মানে বাসে গান গেয়ে কিছু টাকা কামানো, মানে গরম রোদে দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রি করা, মানে পুলিশের ধমক খেয়ে রাত কাটানো। তাদের শৈশবের গল্পগুলো কেবল বঞ্চনা আর দুঃখের।
একটি ছয় বছরের শিশু যদি ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে শুধুমাত্র দু’মুঠো ভাত জোগাড় করার জন্য, তবে তার জীবনের মানে কী? আমরা যখন নিজেদের সন্তানকে নিয়ে স্কুলে যাই, তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পথশিশুটি হয়তো চেয়ে থাকে হাহাকারভরা চোখে। সে ভাবে—কেন আমি নই সেখানে? কেন আমার জন্য নেই চকচকে ইউনিফর্ম, নতুন ব্যাগ আর রঙিন বই?
পথশিশুর প্রতিটি দিন বেঁচে থাকার সংগ্রাম। খাবার তাদের কাছে নিশ্চিত কিছু নয়। অনেক সময় হোটেলের ফেলে দেওয়া ভাত, কখনো ময়লার স্তুপে পাওয়া আধখাওয়া ফলই তাদের আহার। কোনোদিন পেট ভরে খেতে পারলে সেটাই তাদের উৎসব।
আশ্রয় বলতে নেই কোনো ঘর। কেউ ফুটপাথে, কেউ স্টেশনে, কেউ লঞ্চঘাটে বা পার্কে রাত কাটায়। বর্ষায় ভিজে কাপড়ে ঘুম, শীতে কাঁপতে কাঁপতে রাত পাড়ি দেওয়া—এই তাদের বাস্তবতা।
শিক্ষা তাদের জীবনে এক বিলাসিতা। বেশিরভাগ পথশিশুই কখনো স্কুলের ক্লাসরুম দেখেনি। যাদের পরিবার আছে, তারাও জীবিকার জন্য কাজ করে—কারণ পড়াশোনার বদলে টাকা রোজগার জরুরি হয়ে ওঠে। বয়সের আগেই তাদের হাতে এসে যায় রুটি রুজির ভার।
স্বাস্থ্যও এখানে উপেক্ষিত। অসুস্থ হলে ওষুধ জোটে না। সাধারণ জ্বর বা নিউমোনিয়াতেই কত শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আবার অল্প বয়সেই কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ে মাদকাসক্তিতে। আঠা, সিগারেট, গাঁজা—কোনোটাই তাদের অচেনা নয়। এভাবেই ধীরে ধীরে তারা ডুবে যায় অন্ধকারে।
পথশিশুর জীবনে সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা হলো নিরাপত্তাহীনতা। দিনের পর দিন তারা শারীরিক, মানসিক এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। অপরাধচক্র সহজেই তাদের ব্যবহার করে মাদক পরিবহন, চুরি কিংবা ভিক্ষাবৃত্তির কাজে। রাষ্ট্রের সুরক্ষা যাদের সবচেয়ে দরকার ছিল, সেই শিশুরাই রয়ে যায় সুরক্ষার বাইরে।
আমরা সবাই তাদের দেখি, কিন্তু খুব কমই ভাবি। লালবাতিতে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটি যখন ফুল বিক্রি করতে আসে, তখন আমরা বিরক্তি নিয়ে তাকাই। বাসে উঠে গান গাইলে মুখ ফিরিয়ে নিই। অথচ সেই টাকা দিয়েই হয়তো সে রাতে দু’মুঠো ভাত খাবে। আমাদের দৃষ্টিতে তারা বোঝা। অথচ বোঝা তারা নয় বোঝা হলো আমাদের দায়িত্বহীনতা।
পথশিশুর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে আনুমানিক কয়েক লাখ পথশিশু আছে। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ খুবই সীমিত। মাঝে মাঝে আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা হলেও সেগুলোর সংখ্যা অপ্রতুল এবং ব্যবস্থাপনা দুর্বল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পুনর্বাসনের মতো মৌলিক কাজগুলো কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে।
সমাজও এখানে ব্যর্থ। আমরা নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যতটা চিন্তিত, পথশিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ততটা ভাবি না। অথচ এরা যদি শিক্ষিত হয়ে সমাজে ফিরে আসতে পারত, তাহলে হয়তো আজকের অপরাধ চক্র ভেঙে পড়ত।
কিছু এনজিও চেষ্টা করছে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে। ভাসমান স্কুল, অস্থায়ী ক্লাসরুম, খাবার বিতরণ কিংবা পুনর্বাসন কর্মসূচি চালানো হচ্ছে। তবে সেটা সমুদ্রের একফোঁটা জল ছাড়া কিছু নয়। পুরো সমস্যার সমাধান করার মতো উদ্যোগ এখনো নেই।
পথশিশুর জীবনের ছবি মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে আসে, কোনো ক্যামেরার লেন্সে ভেসে ওঠে তাদের কান্না বা হাসি। কিন্তু সেগুলো কয়েক দিনের মধ্যেই ভুলে যাই আমরা। সংবাদ যতটা না পথশিশুর অধিকার নিয়ে হয়, তার চেয়ে বেশি হয় দুঃখের ছবি বা করুণ গল্প নিয়ে। অথচ দরকার তাদের সম্ভাবনা, তাদের স্বপ্নকে তুলে ধরা।
তবু সব অন্ধকারের মাঝেও আলো আছে। অনেক পথশিশু অল্প সুযোগ পেয়ে জীবন বদলে ফেলেছে। কেউ স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখে চাকরি করছে, কেউ খেলাধুলায় এগিয়ে গেছে, কেউবা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জায়গা করে নিয়েছে। এটাই প্রমাণ করে পথশিশুরা বোঝা নয়, সুযোগ পেলে তারাও সমাজের সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।
আজ পথশিশু দিবসে আমাদের ভাবতে হবে আমরা কি শুধু একটি দিন পালন করব, নাকি সত্যিই তাদের জীবন বদলাতে কিছু করব? রাষ্ট্রকে নিতে হবে কার্যকর নীতি, গড়ে তুলতে হবে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র, নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। সমাজকেও বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি পথশিশুকে অবহেলা নয়, বরং সহমর্মিতার চোখে দেখতে হবে।
শিশু মানে স্বপ্ন। শিশু মানে ভবিষ্যৎ। পথশিশুরাও সেই ভবিষ্যতেরই অংশ। তাদের বঞ্চিত রেখে আমরা কোনোদিনই প্রকৃত অর্থে উন্নত সমাজ গড়তে পারব না।
আজকের এই দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে রাস্তার প্রতিটি শিশুকেও আমরা নিজের সন্তানের মতো করে দেখব। আমরা চাই না আর কোনো শিশু ফুটপাথে শুয়ে থাকুক, চাই না আর কোনো শিশু ক্ষুধায় কাঁদুক। আমরা চাই প্রতিটি শিশু স্কুলে যাক, গান গাক, খেলুক, হোক স্বপ্নের আলোয় ভরা। কারণ শিশু কারো সম্পত্তি নয়, শিশু আমাদের সবার।