সম্প্রতি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনা বাংলাদেশের সামাজিক ও আইনি কাঠামোর দুর্বলতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। নিজেকে 'ইমাম মাহদি' দাবি করা মৃত নুরুল হক ওরফে 'নুরাল পাগলা'র মরদেহ কবর থেকে তুলে এনে পুড়িয়ে দিয়েছে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা। এই ঘটনা কেবল মানবিকতার চরম লঙ্ঘনই নয়, বরং দেশের আইন, বিচার ব্যবস্থা এবং সামাজিক সম্প্রীতির ওপর এক গুরুতর আঘাত।
বাংলাদেশের দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ২৯৭ অনুসারে, মৃতদেহের অবমাননা একটি সুস্পষ্ট অপরাধ। হাইকোর্টের বিভিন্ন রায়েও বলা হয়েছে যে মৃতদেহের মর্যাদা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে এই ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কারণ বিপুল সংখ্যক জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার এই নৃশংসতা তারা প্রতিরোধ করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইনের অস্তিত্ব থাকলেও এর প্রয়োগ নিয়ে গুরুতর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোতেও মৃতদেহকে 'কোয়াসি-পার্সন' হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার অর্থ মৃত্যুর পরেও তার মর্যাদা রক্ষা করা আবশ্যক। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও মৃতদেহের অবমাননাকে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন বলে বারবার উল্লেখ করেছে। এই ঘটনাটি দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ক্ষুণ্ন করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইসলাম ধর্ম অনুসারে, মৃত ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষা করা একটি ফরজ দায়িত্ব। রাসূল (সা.) বলেছেন, "মৃত ব্যক্তির হাড় ভাঙা জীবিতের হাড় ভাঙার সমান।" কবর উল্টানো বা মরদেহ পোড়ানো ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এরপরও কিছু মানুষের উগ্র আচরণ ধর্মীয় নির্দেশনাকে অগ্রাহ্য করেছে, যা চিন্তাবিদদের মতে একটি বড় প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক বিদ্বেষ, সামাজিক মেরুকরণ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতা দায়ী। যখন মানুষ আইন হাতে তুলে নেয় এবং রাষ্ট্র কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তখন 'মব জাস্টিস' বা জনতার বিচার ধীরে ধীরে একটি স্বাভাবিক প্রবণতায় পরিণত হয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের স্থিতিশীলতা, সামাজিক সম্প্রীতি এবং সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য মারাত্মক হুমকি।
'মৃত নুর পাগলা বনাম জীবিত আমরা'—এই প্রতীকী তুলনা বাংলাদেশের সামনে এক মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরেছে। আমরা কি মানবিকতা, আইন ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পথে চলব, নাকি অন্ধ উগ্রতার পথ বেছে নেব? যদি রাষ্ট্র মৃতের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে জীবিত মানুষের অধিকার কীভাবে সুরক্ষিত থাকবে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
লেখক: শেখ জাহাঙ্গীর হাছান মানিক,গবেষক ও চিন্তক।