খুবি প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য চলাচলের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী উদ্ভাবন করেছে সৌরচালিত স্মার্ট হুইলচেয়ার। ‘পালসি ড্রাইভ’ নামে এই প্রকল্প সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন পেয়েছে, যা দেশে প্রতিবন্ধী সহায়ক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
ঢাকার রফিক আহমেদের জীবন এই উদ্ভাবনের গুরুত্ব বোঝায়। ১২ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে পড়া রফিক বহু বছর ধরে পুরনো একটি ম্যানুয়াল হুইলচেয়ারের উপর নির্ভর করতেন। ভারী ও অসুবিধাজনক এই চেয়ার ব্যবহার করতে সবসময় অন্যের সহায়তা প্রয়োজন হতো। “আমি যেন বন্দী ছিলাম,” বললেন তিনি। “কোথাও যেতে হলে ভাইয়ের উপর নির্ভর করতে হতো। সে না থাকলে সারাদিন ঘরে বসে থাকতে হতো।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের প্রায় নয় শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বাস করেন। এর মধ্যে একটি বড় অংশ চলাফেরায় সীমাবদ্ধ। বিদেশ থেকে আমদানি করা মোটরচালিত হুইলচেয়ারের দাম দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার ডলারের মধ্যে, যা অধিকাংশ পরিবারের জন্য একেবারেই নাগালের বাইরে। অন্যদিকে সাধারণ ম্যানুয়াল হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর স্বাধীনতাকে সীমিত করে দেয়।
এই বাস্তবতা থেকেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী—আজমাইন ইনকাইদ হক, ফাইরুজ জাহিন খান, জয়দেব গান প্রকাশ এবং মুনজিলা বিনতে মুনির—উদ্ভাবন করেছেন পালসি ড্রাইভ। সৌরচালিত এই হুইলচেয়ার কেবল হাত দিয়ে নয়, কণ্ঠস্বর, চোখের নড়াচড়া, মুখের অভিব্যক্তি কিংবা গলার মাংসপেশির সংকেত দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সক্ষমতাসম্পন্ন ব্যবহারকারীরা সহজে এটি ব্যবহার করতে পারবেন।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে দলটি অংশ নেয় ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব প্রোগ্রামে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত ও বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটি পরিচালিত এই কর্মসূচিতে প্রতিযোগিতা করে তারা পায় ৫৫ হাজার টাকা প্রি-সিড ফান্ড। এর মাধ্যমে প্রোটোটাইপ উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরির সুযোগ তৈরি হয়।
পালসি ড্রাইভের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সাশ্রয়ী মূল্য। একটি ইউনিটের দাম প্রায় ৫০০ ডলার ধরা হয়েছে, যা বিদেশি বিকল্পগুলোর তুলনায় অনেক কম। ভাঁজযোগ্য ও বহনযোগ্য নকশার কারণে এটি সহজে ব্যবহারযোগ্য এবং গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুতের সংকট থাকলেও সৌরশক্তি দিয়ে চালানো সম্ভব।
দলটি ইতিমধ্যে স্থানীয় যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে প্রোটোটাইপ তৈরি করেছে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও খুলনা মেডিকেল কলেজের সঙ্গে কাজ করেছে ব্যবহারকারীদের চাহিদা বুঝতে। এনজিও, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির সহযোগিতায় তারা ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
রফিক আহমেদ পালসি ড্রাইভের প্রথম দিকের পরীক্ষামূলক ব্যবহারকারীদের একজন। তিনি বললেন, “প্রথমবার একা দোকানে যেতে পেরে মনে হয়েছিল আমার ডানা গজিয়েছে। মানুষ এখন আর করুণার চোখে নয়, সম্মানের চোখে দেখে।” তার পরিবারের সদস্যরাও জানিয়েছেন, রফিকের জীবনযাপনে এই ডিভাইস নতুন উদ্দীপনা ফিরিয়ে এনেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্প সরাসরি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন শুরু হলে শুধু প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনমানই বদলাবে না, নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হবে।
পালসি ড্রাইভ দলের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাদের লক্ষ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারেও এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া। “প্রতিটি চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য নতুন শেখার সুযোগ,” বললেন সিইও আজমাইন হক।
প্রযুক্তি, সাশ্রয়ী মূল্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নকশার সমন্বয়ে পালসি ড্রাইভ কেবল একটি যন্ত্র নয়, বরং অনেকের কাছে স্বাধীনতা ও মর্যাদা ফিরে পাওয়ার প্রতীক হয়ে উঠছে।