নুসরাত সুলতানা, খুবি প্রতিনিধিঃ সাগর পেরিয়ে, ভাষার দেয়াল ডিঙিয়ে, স্বপ্নের পাখা মেলে ইতালির এক কোমল বিকেল থেকে একদিন পাখির ডানায় ভর করে স্বপ্ন উড়ে এলো বাংলার শান্ত নদীঘেরা শহর খুলনায়। আর সেই স্বপ্নের নাম ভেরনিকা মোল্লা। ইতালি থেকে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন বাংলাদেশে, এসে পৌঁছেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোকিত চত্বরে, যেখানে প্রতিটি সকাল তার জন্য এক নতুন সূর্যোদয়।
ভেরনিকার জন্ম ইতালিতে হলেও তার বাবা-মা মূলত বাংলাদেশি নাগরিক। জন্মের পর মায়ের পছন্দেই তার নাম রাখা হয়েছিলো ভেরনিকা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যার অর্থ হযরত ঈসা (আ.)-এর প্রকৃত চিত্র।
করোনা মহামারির পর, ২০২১ সালে তারা পারিবারিক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ইতালিতে ভেরনিকা কলেজ পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করেন। খুলনায় বাসা থাকায়, তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জন্য আবেদন করেন। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য যেসব শর্ত প্রযোজ্য ছিলো, তার সবগুলোতেই তিনি যোগ্য ছিলেন। তাই অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার প্রয়োজন মনে করেননি। ইংরেজি ভাষায় তার দক্ষতা থাকায় তিনি ইংরেজি ডিসিপ্লিনকেই বেছে নেন।
বর্তমানে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়ন করছেন।
ইংরেজির সুবর্ণ ডানায় ভেসে আসা এই বিদেশিনী বাংলা নামের এক নতুন নদীর পাড়ে এসে যেন কিছুটা থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশে পা রাখার পরই বুঝেছিলেন, কেবল ইংরেজি জানলেই হৃদয়ের কথা বলা যায় না। বাংলা এখানে কেবল ভাষা নয়, অনুভবের আবরণ, সম্পর্কের রঙ। ক্যাম্পাসে অনেকে ইংরেজিতে কথা বললেও, স্থানীয় বন্ধুদের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে তিনি বাংলা শেখার চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশের খাবার তার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। ইতালিতে পাস্তা, পিজ্জার স্বাদে অভ্যস্ত থাকলেও এখানে পাস্তার জায়গায় এলো ঝাল ঝাল মাছের ঝোল, পিজ্জার বদলে এলো ডাল-ভাতের গন্ধ। প্রথমদিকে মসলাযুক্ত খাবার খেয়ে একটু সমস্যা হতো, কিন্তু ধীরে ধীরে বিরিয়ানি এবং ফুচকা তার প্রিয় তালিকায় যোগ হয়েছে।
তিনি বলেন, ইতালির তুলনায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুটা ভিন্ন। সেখানে শিক্ষার্থীরা বেশি স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করে, আর এখানে নিয়মিত ক্লাস এবং অ্যাসাইনমেন্টের উপর জোর দেওয়া হয়। যদিও প্রথম দিকে ক্লাসের নিয়ম মেনে চলা কঠিন মনে হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি মানিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষকদের সহযোগিতামূলক মনোভাব তাকে অনেক সাহায্য করেছে।
এছাড়াও ইতালি থেকে এসে নতুন বন্ধু পাওয়া কঠিন। তবে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা তার প্রতি খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। তারা তাকে বাংলাদেশি উৎসব, সংস্কৃতি, পোশাক, সংগীত, রীতিনীতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, “আমি প্রথমবার শাড়ি পরেছিলাম মামীর সাহায্যে। এত সুন্দর লাগছিল! কিন্তু হাঁটতে গিয়ে বারবার পা জড়িয়ে যাচ্ছিল,”।
তিনি আরও জানান , অধ্যয়নের মাঝেও বাংলাদেশের একঝাঁক শিক্ষার্থীর হাতে ধরে দিয়েছিলেন ইংরেজি ভাষার আলোকবর্তিকা—আইইএলটিএস শেখাতেন নিবেদিত প্রাণে। এদেশে তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাও আছে।
আজ পড়াশোনার শেষপ্রান্তে এসে তিনি জানিয়েছেন তার সিদ্ধান্ত—বাংলাদেশেই থাকবেন। কারণ এই দেশ তাকে দিয়েছে শান্তি, বন্ধন, আর এমন এক জীবনের স্বাদ, যা হয়তো ইতালিতে ও পাননি। ভেরনিকাকে ঘিরে খুলনার আকাশে আজও হয়তো কোনো বিদেশি পাখি ওড়ে, তবে সে আর ভিনদেশি নয়, সে এখন এই মাটিরই মানুষ—এই শহরের এক অনিবার্য গল্প।