খুবি প্রতিনিধিঃ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিলাম করে চলছে বৃক্ষনিধন। গত শনিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে চারটি গাছ কাটা হয়েছে। গত ০১ সেপ্টেম্বর থেকে গাছ কাটা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৯টি গাছ চার লাখ পয়তাল্লিশ হাজার টাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়েছে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কাছে। গত ০১ সেপ্টেম্বর ও আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত ১০৪টি গাছ কাটা হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদি চত্বর, অদম্য বাংলা, লেক পাড় ও পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের আশপাশের গাছ কাটা হয়েছে। এসব গাছের মধ্যে ৩৭টি রেইন ট্রি, ৩১টি মেহগনি, ৯টি অর্জুন, ৫টি কড়ই, ২টি শিশু, ২টি দেবদারু, ২টি গামার, ১টি আকাশমনি, ১টি ছাতিম, ১টি চম্বল, ১টি জারুল, ১টি আম, ১টি জাম ও ১০টি নারকেল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
আজ বেলা আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে দেখা যায়- অধিকাংশই কেটে ফেলা গাছ ছায়াবৃক্ষ হিসেবে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের চলাফেরা ও আড্ডায় তীব্র রোদ থেকে রক্ষা করত। এর ভিতর অপরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইট থেকে হাদি চত্বরে ছায়াযুক্ত জীবিত ১৬ টি গাছের মাথা কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ কাটার সঙ্গে যুক্ত দুজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুলনার দৌলতপুরের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গাছগুলো নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। ব্যবসায়ী জাহিদ খান কালবেলাকে বলেন, নিলামের মাধ্যমে আমি মৃত গাছ কিনেছি।
গাছ কাটার বিষয়ে একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ। সেখানে পুরোনো গাছ কেটে নিলামের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিটির আহ্বায়ক ফরেস্টি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মো. গোলাম রাক্কিবু বলেন, স্পষ্ট যুক্তিসংগত কারণে মৃত এবং মৃতপ্রায় গাছ বাছাই করে নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গাছ কাটায় ক্ষোভ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। এক শিক্ষার্থী বলেন, “উন্নয়নের নামে গাছ কেটে পরিবেশ ধ্বংসের এই ধারা অত্যন্ত দুঃখজনক। মেহগনি গাছ ছাঁটাই নয়, বরং যেন পরিকল্পিত হত্যার মতো লাগছে!
ইংরেজি ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আলহামজা সিমন বলেন, “ক্যাম্পাস ক্রমেই ইট-পাথর আর কংক্রিটে ঢাকা পড়ছে। প্রশাসনের উদাসীনতায় অনেক গাছ অর্ধমৃত হয়ে গেছে। মেইন গেট থেকে হাদী চত্বর পর্যন্ত সারিবদ্ধ গাছগুলোর মাথা কেটে ফেলা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
এর আগে লাক্কা’ নামক ভাইরাস অপসারণের জন্য গত ১২ ফেব্রুয়ারি এস্টেট শাখা একটি টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৯টি রেইন ট্রি/শিশু গাছ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং আক্রান্ত ডালপালা উন্মুক্ত নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ১৮ ফেব্রুয়ারি গবেষণা ও উদ্ভাবনী কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর ড. কাজী মোহাম্মদ দিদারুল ইসলামের সভাপতিত্বে গঠিত কমিটির সভায় বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে জানা যায়, এর আগেও লাক্কা আক্রান্ত গাছ বিক্রির টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী আপত্তি জানালে গত বছরের ডিসেম্বরে সেটি স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় কমিটি গঠন করে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। পাঁচ মাস পর সরেজমিনে দেখা যায়, আক্রান্ত গাছগুলো ইতোমধ্যে মারা গেছে। এরপর ১২ আগস্ট মৃত গাছগুলো বিক্রির জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়।
এস্টেট শাখার প্রধান শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, “গাছে ভাইরাস হলে তা দ্রুত কাটতে হয়। দেরি হলে গাছ মারা যায়। গত ডিসেম্বরে টেন্ডার দিতে গেলে কিছু শিক্ষার্থী তা স্থগিত করে দেয়। পরে ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় টেন্ডার দেওয়া হয়। এজন্যই গাছগুলো বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
গাছের মাথা কেন কাটা হয়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদেরকে বলা হয়েছে সেজন্য কাটা হয়েছে। আমরা শুধু দায়িত্ব পালন করি।”
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. মো. আহসানুর রহমান বলেন, “‘লাক্কা’ নামক পোকার কারণে, দেরিতে ডাল কাটা হয়েছে বলে গাছ মারা গিয়েছে – এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। কিন্তু গাছের বড় বড় ডাল কাটার কারনে বা পরিকল্পনামাফিক লাক্কা ভাইরাসের ডাল না কাটার কারণে গাছের বেঁচে থাকার সহ্য ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে গাছ মারা যেতে পারে। গাছের মাথা কেটে ফেলার বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদী চত্বর থেকে মেইন গেট পর্যন্ত যেসব গাছের মাথা কেটে ফেলা হয়েছে এটা সম্পূর্ণ অনুচিত। একটি গাছের টিপ কেটে ফেললে তার আর স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না। কর্তৃপক্ষ বলছে এটা প্রুনিং, কিন্তু এটাকে সাধারণত ‘টপিং’ (Topping) বলা হয়। এই পদ্ধতি গাছের জন্য ক্ষতিকর, এমনকি এর আয়ুও কমিয়ে দিতে পারে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. রেজাউল করিম এ বিষয়ে বলেন, যে গাছগুলো নিলামে বিক্রি করা হয়েছে সব মৃত বা অর্ধমৃত গাছ। আমরা ইতোমধ্যে দ্বিগুণ গাছ লাগিয়েছি। জীবিত গাছের মাথা কাটার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমরা গাছের আশেপাশের ডাল-পালা ছেঁটে দেওয়া বিষয়ে বলেছিলাম কিন্তু তাঁরা ভুল করে মাথা কেটে ফেলেছে। পরপরই সর্বোচ্ছ গুরুত্ব দিয়ে গাছগুলোর পরিচর্যা করা হচ্ছে।